৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকান্ড ইতিহাসের কালো অধ্যায় আবার ফিরে দেখা

রক্ষক যখন প্রাণঘাতক। যাদের হাতে ছিল দেহরক্ষার ভার, তাদের হাতেই প্রাণ হারালেন বিশ্বের অন্যতম উজ্জ্বল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ভারতবর্ষের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী। ৩১ শে অক্টোবর ১৯৮৪ ইন্দিরা গান্ধীর শেষের দিনটি কেমন ছিল সেই নিয়েই এই প্রবন্ধ। আসুন, ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়ে  একবার আলোকপাত করা যাক।

১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর, সকাল নটা বেজে পনের মিনিট। স্থান এক নম্বর সফদরজঙ্গ রোড। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবন। আইরিশ অভিনেতা পিটার উস্তিনোভক একটা তথ্যচিত্রের জন্য ইন্টারভিউ নেবেন ইন্দিরা গান্ধীর। অ্যাপয়েন্টমেন্ট ফিক্স করা অনেক আগে থেকেই। সেই ইন্টারভিউ দিতে নিজের বাসভবনে বাগানের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সঙ্গে ছিল দুই দেহরক্ষী সতবন্ত সিং এবং বিয়ন্ত সিং। প্রথমে বিয়ন্ত সিং তার রিভলবার থেকে তিন রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে ইন্দিরা গান্ধীকে লক্ষ্য করে। এরপর সতবন্ত সিং তার স্টেনগান থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি বর্ষণ করে। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইন্দিরা গান্ধী। এই ঘটনার এক ঘন্টা পর দিল্লির অল ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বা এইমস হসপিটালে (AIIMS) মৃত্যু হয় ইন্দিরা গান্ধীর। মোট সতেরোটি গুলি লেগেছিল ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে। যার মধ্যে ডাক্তাররা সাতটি গুলি অপারেশন করে বার করতে পেরেছিলেন। 

হত্যাকারী আততায়ীরা আত্মসমর্পণ করে। ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করার পর তাঁর আততায়ী সতবন্ত সিং বন্দুক ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে, " আমরা আমাদের কাজ সম্পন্ন করেছি, এবার তোমরা তোমাদের কাজ শুরু কর। আমরা আত্মসমর্পণ করছি।"

৩০ অক্টোবর ১৯৮৪।  উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরে শেষ ভাষণ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। ভাষণ লিখে দিয়েছিলেন তাঁর মিডিয়া উপদেষ্টা এইচ ওয়াই সারদা প্রসাদ। ভাষণ দিতে দিতে হঠাৎ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন শ্রীমতী গান্ধী। লিখিত ভাষণের বাইরে গিয়ে বলেন, " আজ আমি বেঁচে আছি কাল নাও থাকতে পারি। কিন্তু আমি গর্বিত যে, আমার পুরো জীবনটা আমি দেশের মানুষের সেবার জন্য উৎসর্গ করতে পেরেছি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত  দেশের সেবা করে যেতে চাই। আমি জানি আমার দেহের প্রতিটি রক্তবিন্দু দেশকে মজবুত করবে।"

ভারতবর্ষের জনসমাজে এক প্রচলিত ধারণা আছে যে মৃত্যুর আগে মানুষ অনেক সময়ে বুঝতে পারে যে সে এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে চলেছে। হয়তো ইন্দিরা গান্ধীও সেরকম কিছু আন্দাজ করে পেরেছিলেন। তাই শেষের দিকে তাঁর ভাষণে অনেক সময়েই চলে আসত নিজের  মৃত্যু প্রসঙ্গ।

৩০ অক্টোবর রাতেই প্লেনে উড়িষ্যা থেকে দিল্লির বাসভবনে ফিরে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্ত ছিলেন। তবুও সারারাত ঘুমোতে পারেননি, ছটফট করেছেন অনিদ্রায়। ইন্দিরা গান্ধীর পাশের ঘরে ছিলেন  পুত্রবধূ সোনিয়া গান্ধী। সে রাতে সাড়ে তিনটে নাগাদ  সোনিয়া হঠাৎ অসুস্থতা বোধ করেন। কমন বাথরুমের পাশেই থাকতো ওষুধের বাক্স। সোনিয়া উঠে সেখান থেকে ওষুধ নিতে যান। সেই শব্দে নিজের বেডরুম থেকে বেরিয়ে আসেন ইন্দিরা। সোনিয়ার শরীরের খোঁজখবর নেন। সঠিক ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন। তারপর বলেন যে, ওনার রাতে ঘুম আসছে না। উনি জেগেই আছেন। যেকোনো প্রয়োজন পড়লে যেন সোনিয়া তাঁকে ডাকে। 

৩১ অক্টোবর ১৯৮৪। সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই কালো পাড়ের গেরুয়া গরদের শাড়ি পরে তৈরি হয়ে যান ইন্দিরা গান্ধী। এরপর আসেন ব্রেকফাস্টের টেবিলে। সেদিন ব্রেকফাস্ট করেছিলেন দুটো পাউরুটি টোস্ট, সিরিয়াল, মৌসম্বি জুস আর ডিম সেদ্ধ। এরপর আসেন ডাঃ মাথুর। প্রতিদিন ওই সময়ে প্রোটোকল মেনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর রুটিন চেক আপ করতেন। আগের রাতে ঘুম কম হলেও, সেদিন সকালে মোটের ওপর তিনি সুস্থই ছিলেন, ব্লাড প্রেসারও ছিল স্বাভাবিক। ডাঃ মাথুরের সাথে কয়েক মিনিট হাল্কা গল্পগুজবও করেন মিসেস গান্ধী। গল্পের বিষয় ছিল মেকআপ। কারণ কিছুক্ষণ আগেই মেক আপ আর্টিস্ট চলে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধীকে মেকআপ করতে। বিদেশি ডকুমেন্টারির ইন্টারভিউর জন্য তাঁকে মেকআপ করতে হয়েছিল সেদিন। তবে হালকা পাউডার আর সামান্য ব্লাশার ছাড়া আর কোন রকমের মেকআপ ব্যবহার করতে মেক আপ আর্টিস্টকে নিষেধ করেন মিসেস গান্ধী। সেই প্রসঙ্গ টেনেই, ডাঃ মাথুরকে ইন্দিরা মজা করে বলছিলেন, মার্কিন রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগন কি হাস্যকর চড়া মেকআপ করে থাকেন। রেগন ৮০ বছর বয়সেও বয়স লুকনোর জন্য চুল কালো কুচকুচে করেন!! সেদিন হালকা মজার ছলেই  হাসতে হাসতে এরকম অনেক  কথা বলছিলেন মিসেস গান্ধী।

ঠিক ন'টা বেজে দশ মিনিট নাগাদ ইন্দিরা গান্ধী বেরিয়ে আসেন বাসভবন থেকে। তাঁর ঠিক পেছনে কালো ছাতা ধরে সেপাই নারায়ণ সিং। পাশেই সঙ্গে ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান, সাবইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল এবং পরিচারক নাথুরাম।

বাসভবন থেকে বেরিয়ে সামনেই ইন্টারভিউয়ের শুটিংয়ের জায়গা পৌঁছনোর পথটুকু চলতে চলতেই ব্যক্তিগত সচিব মিস্টার ধাওয়ানের সঙ্গে সারা দিনের কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করছিলেন ইন্দিরা। এমন সময়েই তাঁর ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে আততায়ীরা। হতচকিত স্তম্ভিত হয়ে যায় তাঁর আশেপাশে থাকা মানুষজন। ততক্ষণে ক্রমাগত গুলিবর্ষণে ইন্দিরা গান্ধী লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। 

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গুলির আওয়াজ পেয়ে আশেপাশের স্টাফ কোয়ার্টারে থাকা সমস্ত কর্মচারী এবং নিরাপত্তা রক্ষীরা সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে আসে। সোনিয়া গান্ধী বাড়ির ভেতর থেকে ছুটে আসেন খালিপায়ে ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থাতেই। রক্তাক্ত ইন্দিরার দেহ দেখে "মাম্মি মাম্মি" করে চিৎকার করে হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন সোনিয়া।

প্রোটোকল অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে সবসময় রাখা থাকে একটা অ্যাম্বুলেন্স। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সেদিন অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার কাজে আসেননি। একটা অ্যাম্বাসাডর গাড়িতে করে ইন্দিরাকে তড়িঘড়ি নিয়ে যাওয়া হয় অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বা এইমস AIIMS- এ। গাড়ির পেছনের সিটে ইন্দিরার মাথাকে কোলে নিয়ে বসেন সোনিয়া। ঝর ঝর করে প্রচুর পরিমাণে রক্ত ক্ষরণ হয়ে চলেছিল ইন্দিরার শরীর থেকে। সোনিয়ার গাউন রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়।

প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কর্মচারীরা এতটাই হতচকিত হতভম্ব ছিলেন যে তাঁরা এইমস- এ  ফোন করে জানাতেও ভুলে যান যে ইন্দিরা গান্ধীকে গুরুতর আহত অবস্থায় হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এইমস হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও তাই এমন টপ প্রায়োরিটি এমার্জেন্সির জন্যও প্রস্তুত ছিলেন না। ইন্দিরাকে ওখানে নিয়ে যাবার পর একটা স্ট্রেচার পর্যন্ত পেতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছিল। 

জুনিয়র ডাক্তাররা ইন্দিরার অবস্থা দেখে ঘাবড়ে যান। তাঁরা সঙ্গে সঙ্গেই সিনিয়র ডাক্তারদের কল করেন। ডাঃ গুলেরিয়া, ডাঃ এস বলরাম, ডাঃ এম এস কাপুর ইন্দিরা গান্ধীর চিকিৎসা শুরু করেন। ইসিজি করা হয় কিন্তু হৃদস্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। একটা নল ইন্দিরার নাকের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করানো হয় অক্সিজেন সরবরাহ করার জন্য। দেহে অক্সিজেন প্রবেশ করিয়ে মস্তিষ্কের কোষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখাটা ছিল ডাক্তারদের কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ। 

আমাদের দেহে যেখানে সাধারণত চার লিটারের মত রক্ত থাকে,  ইন্দিরা গান্ধীকে সেখানে আশি বোতল রক্ত দেওয়া হয়েছিল। যা দেহে থাকা রক্তের প্রায় পাঁচ গুণ। রক্তক্ষরণ কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিল না। গুলিতে গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গেছিল ইন্দিরা গান্ধীর  শরীর।

সত্যি কথা বলতে কি, ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হয়েছিল একেবারে ইন্দিরা হত্যার ঘটনাস্থলেই। ডক্টর গুলেরিয়া বলেছিলেন মিসেস গান্ধীকে মৃত অবস্থাতেই হাসপাতালে আনা হয়েছিল। এমন আকস্মিক দুঃসংবাদে সারা দেশের সামাজিক অবস্থা বেসামাল হয়ে যাবে, এ আশঙ্কা করেই, এইমস হসপিটালে উপস্থিত দেশের তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী শংকরানন্দ নির্দেশ দেন তখনই ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর খবর সরকারি ভাবে ঘোষণা না করতে। 

ডাক্তাররা ইন্দিরাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যান দেহ থেকে গুলি বের করার জন্য। আর প্রয়োজনীয় যত ভাবে সম্ভব কোন ভাবে লাইফ সাপোর্টের বন্দোবস্ত করার।

দুপুর দুটো বেজে ত্রিশ মিনিটে সরকারি ভাবে ঘোষণা করা হয় যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হয়েছে। সারা দেশের পরিস্থিতি হয়ে যায় থমথমে। কোথাও ইন্দিরাকে হারানোর শোক । কোথাও এভাবে নিজের দেহরক্ষীদের হাতেই নিষ্ঠুরভাবে ইন্দিরাকে হারানোর ক্ষোভ। ভয়ঙ্কর এক পরিস্থিতির মধ্যে চলে যায় ভারতবর্ষ।

এর পরবর্তীকালে আমরা অপারেশন ব্লু স্টার নিয়ে আলোচনা করব এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। কারণ ইন্দিরা গান্ধী হত্যাকাণ্ডের মূল চক্রান্ত লুকিয়ে আছে অপারেশন ব্লু স্টারের মধ্যে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন