ক্ষমা করো সেকাল একালের দ্রৌপদীরা

তিনি বিশ্বের নারীবাদের পথিকৃৎ। সৃষ্টির আদি লগ্ন থেকে চলে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রচলিত নিয়মকে প্রশ্নবিদ্ধ করার পথপ্রদর্শক ছিলেন দ্রুপদ রাজকন্যা পাঞ্চালি দ্রৌপদী। 



তিনি পাঁচজন পুরুষকে বিয়ে করেছিলেন, তবুও কেউই তাঁকে ভালোবাসেননি। পাঁচ স্বামীর পত্নী হয়েও তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গ রাণী। তাঁকে বিশ্বের সবথেকে ভয়ঙ্কর ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের জন্য দায়ী করা হয়েছিল, যা সমগ্র ভূখণ্ডকে গ্রাস করতে চেয়েছিল ব্রহ্মাস্ত্র, পশুপতি অস্ত্রের ভয়াবহতায়। 

যাইহোক, এই মহাকাব্য মহাভারত দুহাজার বছরেরও বেশি আদি। তাই সমগ্র ঘটনা পুনরাবৃত্তি করার প্রয়োজন নেই। তবে দ্রৌপদীর জীবনের কয়েকটি বিশেষ দিক তুলে ধরব, যেগুলি একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ভারতের নারীদের জীবনের সাথে এখনও ওতপ্রোত ভাবে সংযুক্ত । কিন্তু দুঃখের বিষয়, মহাভারতের দ্রৌপদীকে প্রায় দুই সহস্রাব্দ আগে যে পুরুষতান্ত্রিক পরীক্ষা ও বেদনা সহ্য করতে হয়েছিল, তা আজও বিদ্যমান এই 'স্মার্ট' ইন্ডিয়ায়।

শুরু করা যাক তাঁর অলৌকিক জন্মের মাধ্যমে। যজ্ঞের আগুন থেকে জন্মলাভ করেছিলেন দ্রৌপদী, এই বিশাল যজ্ঞের উদ্যোক্তা ছিলেন তাঁর পিতা রাজা দ্রুপদ। যজ্ঞের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল একটি শক্তিশালী পুত্র সন্তানের সৃষ্টি করা, শৌর্য বীর্যে শক্তিমান যে পুত্র সন্তান রাজা দ্রুপদ এর চিরশত্রু দ্রোণাচার্যকে হত্যা করে অপমানের প্রতিশোধ নিতে পারবে। তাই, যখন দ্রৌপদী তার যমজ ভাই ধৃষ্টদ্যুম্নর পরে আগুন থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন, তখন তাঁকে একটি অবাঞ্ছিত শিশু হিসাবেই মনে করা হয়েছিল, অনেকটা আমাদের দেশের সেইসব অবাঞ্ছিত কন্যাশিশুদের মতো যাদেরকে পরিত্যক্ত করা হচ্ছে, যাদের ভ্রূণ অবস্থাতেই হত্যা করা হচ্ছে বা জন্ম নেওয়ার জন্য ঘৃণা করুণার চোখে দেখা হচ্ছে। পিতৃতন্ত্র কন্যারত্নকে এখনও 'দায়ভার' হিসেবেই বিচার করে। হ্যাঁ! কন্যা এখনও এই ভারতীয় সমাজের কাছে বিশাল এক দায়িত্ব, বিশাল দায়ভার।

এই দায়ভার এর মূল কারণ কন্যার বিবাহের জন্য পিতা কে বহন করতে হয় বিপুল পরিমাণ ধন সম্পদ। প্রাপ্তবয়স্ক হতে না হতেই দ্রৌপদীর 'স্বয়ম্বর' আয়োজন করেন তাঁর পিতা; যাতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পিতৃদায় মিটিয়ে ফেলা যায়। তৃতীয় পাণ্ডব অর্জুনকে স্বয়ম্বর সভায় তীরন্দাজী প্রতিযোগিতায় বিজয়ীর পুরস্কার হিসাবে দান করা হয়েছিল দ্রৌপদীকে। মনে মনে হয়তো অর্জুনকে হৃদয়ের মনি কোঠায় সঞ্চিত সমস্ত ভালোবাসা শুভ দৃষ্টিতেই প্রদান করেছিলেন দ্রৌপদী। কিন্তু তবুও ভাগ্যের বিধানে একান্ত আপন ভাবে অর্জুনকে পেলেন না পাঞ্চালি। শাশুড়ির আদেশে তাই অনিচ্ছাকৃতভাবে বহুপতিত্বের দিকে ঝুঁকতে হলো দ্রুপদ-কন্যাকে। আজও ভারতীয় পরিবারে বধূ শাশুড়ির আজ্ঞাবাহক হতে বাধ্য।

দুর্ভাগ্যবশত, বহুবিবাহ সম্পর্কের শিকারও হয়েছিলেন দ্রুপদ-কন্যা। কারণ, তাঁর সমস্ত স্বামীরা অন্য স্ত্রী গ্রহণ করেছিল। আজও অনেক ভারতীয় পরিবারে এই ঘটনা আশ্চর্যের কিছু নয়। আর এ ধরণের ঘটনারই প্রতিবিম্ব আমরা দেখতে পাই আমাদের টিভি সিরিয়াল গুলিতে। একজন নারীর ভাগ্য তার বাবা, স্বামী, পুত্র বা শ্বশুরবাড়ির দ্বারা নির্ধারিত হয়। তাকে এখনও পুরুষদের সম্পত্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।

ঋষি ব্যাস তাঁকে বর দিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। অনুমিত 'বরণ' অনুসারে। ঋষি ব্যাসের বরদান অনুসারে, দ্রৌপদী  প্রতিবার সহবাসের পর আবার সতীত্ব অর্থাৎ ভার্জিনিটি ফিরে পেতেন। এখনও আমরা একজন মহিলার অক্ষত হাইমেনের প্রতি ভারতীয়দের বিশেষ উৎসাহের অনেক উদাহরণ দেখতে পাই। একটা পাতলা চামড়া যা সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে বিভিন্ন কারণে, তাকে অক্ষত হিসেবে পাওয়া নিয়ে কি অসীম পৌরুষত্ত্বের অহংকার। ফুলশয্যার রাতে নববধূর যোনি থেকে রক্ত বার করার উল্লাস। তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর এই বিষয়টার একজন মহিলার চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং পবিত্রতাকে চিহ্নিত করে আজও আমাদের সমাজ এবং সমাজ ব্যবস্থা।

এবার আলোকপাত করা যাক তাঁর জীবনের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক দিনে - যেদিন প্রকাশ্যে অপমানিত এবং অসম্মানিত হয়েছিলেন দ্রৌপদী। জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় তাঁকে হারানোর পর, রজস্বলা অবস্থায় থাকা দ্রৌপদীকে দ্বিতীয় কৌরব দুঃশাসন চুল ধরে টেনে অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের রাজসভায় নিয়ে যায় এবং আশ্চর্যজনকভাবে রাজসভায় উপস্থিত তৎকালীন ভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, রথী-মহারথীরা এই অন্যায় সহ্য করে। এর প্রতিবাদ করেনি কেউই। রাজদরবারে উপস্থিত যোদ্ধা, প্রবীণ ও অভিজাত, কেউই সেই অপমান থামানোর সাহস সঞ্চয় করতে পারেননি। 

একটু চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন এটি বর্তমান সমাজেও বেশ পরিচিত দৃশ্য। বর্তমান ভারতের মহিলারা প্রায় প্রতিদিনই যা সহ্য করেন। প্রতিদিন প্রায় এরকমই পরিস্থিতির মুখোমুখি হন তাঁরা। 

অবাক লাগছে বুঝতে? অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়ই। ভেবে দেখুন ভিড় বাসে, ট্রেনে এমনকি রাস্তার মাঝখানে যখন একজন মহিলাকে হেনস্থা করা হয় বা শ্লীলতাহানি করা হয় তখন কতজন লোক তাঁদের হয়ে আওয়াজ তোলে? পরিবর্তে, তারা সেখানে নিষ্ক্রিয় পথচারী হিসাবে দাঁড়িয়ে থাকে এবং সাহায্যের জন্য তার কান্নার দিকে অন্ধ দৃষ্টি দেয় বধির হয়ে। অন্ধ রাজা ধৃতরাষ্ট্রের মত তারাও যেন বুঝতে পারে না কি হচ্ছে ঘটনাটা। এবং দুর্ভাগ্যবশত চোখে কালো পট্টি বাঁধা আইনি দেবীর দরবারেও বেশিরভাগ অপরাধীরা শাস্তি পায় না।

কিন্তু এখানে বিশেষভাবে একটি জিনিস আছে যা মহাভারতের দ্রৌপদীকে আজকের মহিলাদের থেকে আলাদা করে। আজকের মহিলারা আরো বেশি অসহায়। দ্রৌপদীর থেকেও। পাঞ্চালের ব্যক্তিত্বসম্পন্না, কৃষ্ণবর্ণা রাজকন্যা সাহসের দিক থেকে আজকালকার ভারতের নারীদের থেকেও উচ্চস্তরের ছিলেন, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কারণ পাঞ্চালির কাছে ছিল কৃষ্ণের মতো একজন অনুগত এবং নির্ভীক সখা। যিনি কঠিন দুঃসময়ে তাঁর পাশে থেকে তাঁকে উদ্ধার করেছেন। আজকের ভারতীয় নারীরা কৃষ্ণের মতো সখা সংগ্রহেও বঞ্চিত। কারণ এখন বিবাহের পর নারী-পুরুষের গভীর বন্ধুত্বকে সম্পর্কের বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রশ্নচিহ্নের সম্মুখীন হতে হয়। তাদের কাছে কৃষ্ণের মতো করুণাসিন্ধু সখাও নেই, যে তাদের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষা করবে, বিভিন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে সচেষ্ট হবে । 

তাই ভারতের বর্তমান প্রজন্মের মহিলারা, এই নতুন যুগের দ্রৌপদীরা, এটি জানেন। এবং তাঁরা নিজেদের জীবন সংগ্রামের যুদ্ধের জন্য স্ব-উদ্যোগে নিজেদের প্রস্তুত করছেন। কৃষ্ণ শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আধুনিক দ্রৌপদীদের। প্রয়োজনে হোক নারীর সম্মান রক্ষার জন্য মহাভারতের দ্বিতীয় যুদ্ধ। বঞ্চিত নিপীড়িত-নির্যাতিত ভারতীয় নারীদের অভিমানের তেজে তপ্ত হয়ে ভারত ভূমি হোক পবিত্র।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন